স্বাধীনতাত্তোর প্রাথমিক শিক্ষায় বঙ্গবন্ধুর অবদান এবং বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় প্রাথমিক শিক্ষা”
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙ্গালি জাতির ভাগ্য উন্নয়নে সারাজীবন সংগ্রাম করেছেন। শিক্ষা ছাড়া জাতির উন্নতি যে সম্ভব নয় তা অনুধাবন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাই তিনি একটি শিক্ষিত জাতির স্বপ্ন দেখেছিলেন। শোষনমুক্ত ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গড়ে তুলেছিলেন যুগোপযোগী ও আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা।
শিক্ষার প্রতি বিশেষ আগ্রহ ছিল বঙ্গবন্ধুর । ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনের সময়ও তিনি কার্যকরী সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু শিক্ষাকে জনমুখী ও সম্প্রসারণ করতে কোনো কৃপণতা করেননি।বঙ্গবন্ধু দেশকে নিরক্ষর মুক্ত করতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রুপান্তর করতে । বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা বিস্তার ও নিরক্ষরমুক্ত দেশ গড়ার প্রধান পদক্ষেপ ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ। সে লক্ষ্যে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে ৩৭ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ,১১ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন,৪৪ হাজার শিক্ষক নিয়োগ ও চাকুরী সরকারি করণ,৫ম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে বই ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে পোশাক প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলেন । বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই ডঃ মুহাম্মদ কুদরত এ খুদা কে সভাপতি করে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করেন, সেই শিক্ষা কমিশন বেশ কয়েকটি মূল্যবান পরামর্শ প্রদান করে যার ভিত্তিতে দেশের শিক্ষা কার্যক্রম চলতে থাকে।
বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার পর দেশ পরিচালনার জন্য যে সংবিধান প্রনয়ন করেন তাতে তিনি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদে শিক্ষার বিষয়টি উল্লেখ আছে তাতে রয়েছেঃ
১৭(ক) : একই পদ্বতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক বালিকার জন্য রাষ্ট্র কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।১৭(খ) : সমাজের প্রযোজনের সাথে শিক্ষাকে সঙ্গতিপূর্ণ করার জন্য এবং সেই প্রয়োজন সিদ্ধ করার উদ্দেশ্যে যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও সদিচ্ছা প্রণোদিত নাগরিক সৃষ্টির জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
১৭(গ): আইনের দ্বারা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করার জন্য রাষ্ট্র প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে ।
বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবদ্দশায় শিক্ষা সম্পর্কিত যে আইন গ্রহণ করেছিলেন এবং যা বাস্তবায়নে চলমান ছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো ”প্রাথমিক স্কুল অ্যাক্ট ১৯৭৪”। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু সরকার স্বাধীন দেশে প্রথম যে বাজেট ঘোষণা করেছিলেন তাতে প্রতিরক্ষা খাতের চেয়ে শিক্ষা খাতে ৭% বরাদ্দ বেশি রেখেছিলেন। কারণ তিনি জানতেন প্রতিরক্ষা খাত দিয়ে নিরক্ষর মুক্ত দেশ গড়া যাবেনা , শুধু শিক্ষা দিয়েই দেশকে নিরক্ষরমুক্ত করে জাতিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন যুদ্ধোত্তোর বাংলাদেশ পুণর্গঠনে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছিলেন এবং বাংলাদেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করতে চেয়েছিলেন ঠিক তখনই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে পরাজিত পাকিস্থানী হানাদারদের দোসর ও বিপথগামী কতিপয় দেশীয় সৈনিকদের দ্বারা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে সাহাদৎ বরণ করেন । জাতির এ মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাহাদতের কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার পদক্ষেপ মুখ থুবড়ে পড়ে । স্থবিরতা নেমে আসে প্রাথমিক শিক্ষায় ।
দীর্ঘ ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালে বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার প্রথমবার ক্ষমতা গ্রহণের পর শিক্ষা খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে বাজেট প্রণয়ন করেন । অবহেলিত প্রাথমিক শিক্ষা যেন আবার প্রাণ ফিরে পায় ।প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নে সময়োপযোগী ও কার্যকর বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় । ২০০৯ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সরকার ”জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০১০” প্রণয়ন করেন । জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর আলোকে একটি আধুনিক, বিজ্ঞানমনষ্ক ও প্রযুক্তি জ্ঞান সম্পন্ন জাতি গঠনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নপূরণে ভিশন ২০২১ শীর্ষক লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় । ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত দেশে পরিণত করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় । আর এ লক্ষ্য অর্জনের জন্য মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয় ।
বর্তমান সরকারের আমলে প্রাথমিক শিক্ষা খাতে সবচেয়ে বড় অর্জন হলো ২০১১ খ্রিঃ থেকে প্রতি বছরপ্রায় দুই কোটি শিক্ষার্থীর হাতে চার রঙের আকর্ষণীয় সম্পূর্ণ নতুন পাঠ্যপুস্তক বিনামূল্যে শিক্ষা বছরের প্রথম দিনেই বই উৎসবের মাধ্যমে তুলে দেয়া হচ্ছে ।
শিক্ষার্থীদের মেধা যাচাই ও মূল্যায়নের জন্য ২০০৯ খ্রিঃ থেকে সারাদেশে অভিন্ন প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা গ্রহণ করা হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মেধাবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে ।মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে তাঁর পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ২০১৩ সালে ২৬ হাজার ১৯৩ টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করেন যা বর্তমান সরকারের অন্যতম সেরা অর্জনগুলোর একটি।২০১৪ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকদের জীবনমান, প্রশাসনিক উন্নয়ন ও সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধিতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা প্রধান শিক্ষক পদটিকে দ্বিতীয় শ্রেণির গেজেটেড কর্মকর্তার পদমর্যাদায় উন্নীত করেন । মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করণে ২০১৩ খ্রিঃ থেকে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম-কমিশনের মাধ্যমে বিসিএস উত্তীর্ণদের মধ্য হতে প্রধান শিক্ষক হিসাবে নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়েছে । এ ছাড়াও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকদের পদমর্যাদা বৃদ্ধি ও জীবনমান উন্নয়নে ১৫তম গ্রেড থেকে ১৩তম গ্রেডে উন্নীত করা হয়েছে ।
সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদ্যালয় বিহীন গ্রামে নতুন বিদ্যালয় স্থাপন কল্পে সারাদেশে ১৫০০টি নতুন প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করেন । তাছাড়াও বিদ্যালয় বিহীন গ্রামে আরো ১০০০টি বিদ্যালয় স্থাপনের কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন রয়েছে ।
প্রাথমিক শিক্ষার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে আনা ও ধরে রাখা । এ কাজের বাস্তবতা মোকাবেলায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার মোবাইল ব্যংকিং এর মাধ্যমে শতভাগ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তির আওতায় এনেছেন যা শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া রোধ এবং শিক্ষার্
গুণগত মান নিশ্চিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে । এ ছাড়াও শিক্ষার্থীদের স্কুলড্রেস, ব্যাগ ও জুতা ক্রয়ের জন্য এককালীন কীডস
অ্যালাউন্স হিসাবে প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে ১০০০ টাকা করে প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
শিক্ষার্থীদের পরিপূর্ণ সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তুলতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলা , সাংস্কৃতিক কর্ম কান্ডসহ নানা সহপাঠক্রমিক কার্যক্রম চালু করেছেন । এরই ধারাবাহিকতায় ২০১১ খ্রিঃ থেকে নিয়মিত ভাবে প্রতিবছর স্কুল পর্যায় থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্ণামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে । এর ফলে ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও আজ ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় বিশ্বে তাদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখছে ।
বিদ্যালয় পর্যায়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা (SLIP) বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রতিটি বিদ্যালয়ে ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা প্রদান করা হচ্ছে । এছাড়াও ক্ষুদ্র মেরামত বাবদ ১.৫ লক্ষ থেকে ২ লক্ষ টাকা ,রুটিন মেইনট্যানেন্স বাবদ ৪০ হাজার টাকা এবং ওয়াশব্লক মেরামত বাবদ ১০-২০ হাজার টাকা প্রদান করা হচ্ছে । যার ফলে উক্ত ক্যাচমেন্ট এলাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনটি দৃষ্টিনন্দন ভবন হিসেবে সকলের নজর কাড়ছে ।
বর্তমান সরকারের আমলে অগ্রাধীকার ভিত্তিতে দেশের সকল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে বিদ্যুতায়নের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে । যার ফলে শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল
পাঠদান সহ অত্যাধুনিক সুবিধা ভোগ করছে ।
শিক্ষকদের পেশাগত ক্ষমতা বৃদ্ধি ও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোকে একাডেমিক সহায়তা প্রদানের জন্য উপজেলা পর্যায়ে উপজেলা রিসোর্স সেন্টার ( URC ) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে । তাছাড়া পিটিআইগুলোতে সিইনএড প্রশিক্ষণের পরিবর্তে দেড় বছর মেয়াদী ডিপিএড প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে ।
যার প্রেক্ষিতে শিক্ষার্থীরা আধুনিক ও যুগোপযোগী পাঠ গ্রহণের সুবিধা ভোগ করছে ।
সেমিনারের বিষয় বস্তুর আলোকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে কেবল প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে চিত্রায়নের প্রেচেষ্টা করা হয়েছে মাত্র
।
বাংলাদেশ চিরজীবী হউক ।
No comments